চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ক্লাবের ফটকে লেখা ছিলো লাইনটা। বলা বাহুল্য ক্লাবটা ইউরোপীয়ানদের। বিশের দশকে চট্টগ্রাম ছিল বিপ্লবিদের আঁখড়া, আর সেই চট্টগ্রামেই কীনা এমন ক্লাব! স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লবিদের নজর ছিল এ ক্লাবের উপর, তার উপরে ক্লাবটি ছিল সরকারি ও ফৌজি অফিসারদের ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র। বারকয়েক হামলার পরিকল্পনা ও চেষ্টা চালান বিপ্লবিরা, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হতে হয়। অবশেষে ১৯৩২ সালে আসে বিপ্লব, সেইসাথে জন্ম হয় এক মিথের- প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।




২৩ সেপ্টেম্বর, শনিবার, রাত ১০ টা। সূর্য সেনের বিপ্লবি দলের পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮ জনের একটি গ্রুপ আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে এগুতে থাকে পাহাড়তলী ক্লাবের দিকে। এই গ্রুপের নেতৃত্বের ভার ছিল মাত্র ২১ বছর বয়সী প্রীতিলতার উপর। পাঞ্জাবী সাজ ধারণ করে প্রীতিলতা অংশ নেন এ আক্রমণে।

শনিবারের দিনটিতে ক্লাবে প্রায় জনা চল্লিশেক মানুষ আমোদ প্রমোদে মত্ত ছিলো৷ পুরো ছক সাজিয়ে এসেছিলেন প্রীতিলতার দল। তিনভাগে বিভক্ত হয়ে তিনদিক থেকে আক্রমণের প্রস্তুতি নেন তাঁরা। পূবের গেটে রিভলবার ও বোমা নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী ও কালীকিংকর দে; সুশীল দে ও মহেন্দ্র চৌধুরী রিভলবার নিয়ে অবস্থান করছিলেন দক্ষিণের দরজায় এবং রাইফেল ও হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন ও প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানলায় প্রস্তুত ছিলেন।

প্রীতিলতার সংকেত দেওয়ার সাথে সাথে বিপ্লবি দলটি ঝাপিয়ে পড়ে। গুলি ও বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। অন্ধকারের মধ্যে ছুটাছুটির এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত ব্রিটিশ মিলিটারি অফিসারের রিভলবারের এলোপাথাড়ি গুলি এসে প্রীতিলতার বাঁ পাশে লাগে। মিলিটারি মোটরগাড়ির উপস্থিতি অনুমান করে প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ করে বিপ্লবি দলটি এগিয়ে যায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর নিথর দেহ পড়ে থাকে ক্লাবের অদূরেই।

পুলিশ-মিলিটারিরা যখন প্রীতির মৃতদেহ আবিষ্কার করেন, তখন তাঁর শরীর অনুসন্ধান করে পাওয়া বিভিন্ন জিনিসের সাথে পাওয়া যায় তাঁর নিজের হাতে লেখা একটি বিবৃতি। তার অংশবিশেষের বক্তব্য ছিলো এরকম-

"দেশের মুক্তি সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না?....নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়াছে যে তাহারা আজ পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে না। নিজ মাতৃভূমির মুক্তির জন্য যে কোনো দুরূহ বা ভয়াবহ ব্যাপারে ভাইদের পাশাপাশি দাঁড়াইয়া সংগ্রাম করিতে তাহারা ইচ্ছুক- ইহা প্রমাণ করিবার জন্যই আজিকার এই অভিযানের নেতৃত্ব আমি গ্রহণ করিতেছি।

আমি ঐকান্তিকভাবে আশা করি যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন- এই আশা লইয়াই আমি আজ এই আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।”

পাহাড়তলীর মরণচূড়ায় ঝাপ দেওয়া অগ্নিকন্যার আত্মাহুতি দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা।